ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চাঁদা আদায়ের ছবি ধারণ করায় সাংবাদিককে মারধর করে মোবাইল ছিনিয়ে নিল সার্জেন্ট

কক্সবাজারে ট্রাফিক পুলিশের 'আসকারায়' যত্রতত্র পাকিং, কোটি টাকার বাণিজ্য 

বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ
কক্সবাজারে ট্রাফিক পুলিশের 'আসকারায়' যত্রতত্র পাকিং, কোটি টাকার বাণিজ্য 

কক্সবাজারে ট্রাফিক পুলিশের 'আসকারায়' যত্রতত্র পাকিং থেকে প্রতিমাসে কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। বুধবার সকালে কক্সবাজার শহরের কলাতলী পয়েন্টে অবৈধভাবে পার্কিং করা যাত্রীবাহি বাস থেকে চাঁদা আদায়ের ছবি ধারণ করায় এক সাংবাদিককে মারধর করেছে মাজাহারুল ইসলাম নামের এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। এই সময় সাংবাদিকের মোবাইল ফোন ও পত্রিকায় আইডি কার্ডও ছিনিয়ে নেয়া হয়।

মারধরে শিকার সাংবাদিক রাশেদুল মজিদ, কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত দৈনিক সকালের কক্সবাজার পত্রিকার বার্তা প্রধান।

অভিযুক্ত ট্রাফিক সার্জেন্ট মাজাহারুল ইসলাম কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত। সাংবাদিক মারধরের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যামে ছড়িয়ে পড়লে ট্রাফিক পুলিশ ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে সাধারণ মানুষ, ভুক্তভোগী লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ঘটনায় জড়িত সার্জেন্ট মাজাহারুল সহ দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের দাবি তুলেন। এমনকি ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল। এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে সামাজিক সংগঠন ‘আমরা কক্সবাজারবাসি’। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর সভাপতিত্বে সভায় এ ঘটনায় অভিযুক্ত ট্রাফিক সার্জেন্টের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সহ ট্রাফিকের চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানানো হয়।

অন্যদিকে এঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ (সদর সার্কেল) মো.মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে।

রাশেদুল মজিদ জানিয়েছেন, সকালে ব্যক্তিগত কাজে একটি অটোরিকশা যোগে বাস টার্মিনালে যাওয়ার সময় কলাতলীর মোড়ে যত্রতত্রভাবে বাস পাকিং করে যাত্রী উঠা-নামার কারণে তীব্র যানজট লক্ষ করা গেছে। তিনি ওই সময় নিজের মোবাইল বের করে ছবি ধারণ করেন। এসময় ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত ট্রাফিক সাজেন্ট অবৈধভাবে পাকিং করা একটি বাস চালক থেকে টাকা নিতে দেখা যায়। এই ছবিটি ধারণ করার সাথে সাথে সার্জেন্ট দৌঁড়ে এসে মারধর করতে করতে মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নেন। এসময় সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় পত্র কার্ডটি দেখালে তাও ছিনিয়ে নেন।

রাশেদুল মাজিদ বলেন, এ ঘটনার পর পর ঘটনাস্থল ত্যাগ করে বিষয়টি পুলিশের উর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করেছি। একই সঙ্গে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেছি। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঘটনার বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর পর সাংবাদিককের ছিনিয়ে নেয়া মোবাইল ফোন ও কার্ডটি উদ্ধার করা হয়েছে। এব্যাপারে পুলিশের নিজস্ব তদন্ত শুরু হয়েছে। ঘটনায় অভিযুক্ত সার্জেন্টের বিরুদ্ধে পুলিশের নিজস্ব নিয়মে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। মোবাইল ফোন ও কার্ড সাংবাদিককে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।

অভিযুক্ত ট্রাফিক সার্জেন্ট মাজাহারুল ইসলাম মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, মোবাইল কেড়ে নিতে গিয়ে হাতা-হাতির ঘটনা ঘটেছে। কেন মোবাইল ছিনিয়ে নিতে হল এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা একটি অনাকাংখিত ভুল বুঝাবুঝি। অভিযোগে প্রকাশ, কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে অসাধু কিছু কর্মকর্তা এইসব অবৈধ পাকিং থেকে কোটি টাকার বাণিজ্য করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এমনকি ট্রাফিক পুলিশের বাণিজ্যের বিষয় অনেকটা প্রকাশ্যে। পার্কিং ছাড়াও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দালাল নিয়োগ করে মাসিক, ত্রৈমাসিক চাঁদাবাজি করে আসছে ট্রাফিক বিভাগ।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্য নেয়ার জন্য মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। মুঠোফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

২৪ ঘন্টায় অপসারণের দাবী

কক্সবাজারে ট্রাফিক পুলিশের ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতি ও প্রকাশ্যে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বৃহৎ সামাজিক সংগঠন ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’। একই সাথে কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক ও আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠনের জেলা শাখার পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক রাশেদুল মজিদকে ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃক শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার প্রতিবাদও জানানো হয়। তৎক্ষণিক বিক্ষোভকারীরা সার্জেন্ট মো. মাজহারুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসীম উদ্দীন চৌধুরী সহ দুর্নীতিতে যারা জড়িত তাদের আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে অপসারণের দাবী জানান।

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বেলা ১২ টার দিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশে আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই দাবী জানান।

বিক্ষোভকারীরা বলেন, দৈনিক সকালের কক্সবাজার পত্রিকার বার্তা প্রধান ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক রাশেদুল মজিদ বুধবার সকালে কলাতলীর মোড়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যান। এসময় তিনি সড়কের উপর অবৈধ পার্কিং এবং যানজটের ছবি ধারণ করেন নিজ মোবাইলে। বিষয়টি দেখে তৎক্ষণিক সাংবাদিক রাশেদুল মজিদকে শারীরিক আক্রমন করে তার মোবাইল ছিনিয়ে নেন দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মাজহারুল। নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আইডি কার্ড দেখানো হলেও ওই ট্রাফিক সদস্য কার্ডও ছিনিয়ে নেন সাংবাদিকদের। একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে একজন পেশাদার সাংবাদিকের সাথে এমন আচরণ করতে পারে না। ট্রাফিকের অবৈধ লেনদেন ও অপরাধ কর্মকান্ড আড়াল করতে সার্জেন্ট মাজহারুল সাংবাদিককে আক্রমন করেছে। দ্রুত হামলাকারী সার্জেন্ট ও ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্থ সদস্যদের অপসারণের দাবী জানানো হয়। একই সাথে রাশেদুল মজিদ একজন পরিবেশ সংগঠক এবং আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠনের জেলা শাখার পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক।

সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক মহসীন শেখ বলেন, ট্রাফিক পুলিশ কক্সবাজারে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম করে যাচ্ছে। শহরের প্রতিটি মোড় থেকে দৈনিক ও মাসিক চাঁদা তুলে ট্রাফিক পুলিশ। শুধু মাত্র কলাতলীর মোড় থেকে দৈনিক লাখের উপর চাঁদাবাজি করে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। তাদের চাঁদাবাজি প্রকাশ্যে। যার কারণে সাংবাদিক দেখা মাত্রই আক্রমণ করেছে। বিতর্কিত সার্জেন্ট মাজহারুল এবং ট্রাফিকের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দীন চৌধুরীকে আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে অপসারণের দাবী জানাচ্ছি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দীন বলেন, কক্সবাজারে ট্রাফিকের চাঁদাবাজি প্রকাশ্যে। বাস কাউন্টার, টমটম, সিএনজি, বাস, বাইক, নোহা-কারসহ সড়কের পাশে অবৈধভাবে পার্কিং বসিয়ে চাঁদা আদায় করে যাচ্ছে। কলাতলীর মোড়ে তাদের চাঁদাবাজী প্রকাশ্যে। ট্রাফিকের প্রতিটি সদস্য এই অনিয়মের সাথে জড়িত। তারা চাঁদার টাকা ভাগবাটোয়ারা করেন নিয়মিত। যার কারণে ট্রাফিকের সদস্যরা এতো বেপরোয়া।

বিক্ষোভ সমাবেশে আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বলেন, ট্রাফিকের দুর্নীতি সীমা লঙ্ঘন করেছে। তারা নিয়মিত সাধারণ মানুষকে হয়রাণি করে যাচ্ছে। প্রতিটি পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদা নিচ্ছেন। এমনকি অনিয়মের ছবি তুলতে যাওয়া পেশাদার সাংবাদিককে হামলা করতেও বিবেকে বাঁধা দিচ্ছে না। এসময় অনিয়ম-চাঁদাবাজে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানাচ্ছি।

প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠনের সহ-সভাপতি কমরেড সমীর পাল, সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিন পিয়ারু, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র রফিকুল ইসলাম, দৈনিক সকালের কক্সবাজার এর সম্পাদক ও প্রকাশক সাংবাদিক ফরহাদ ইকবাল, কক্সবাজার শহর শাখার সভাপতি সফিনা আজিম ও সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন।

এসময় উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনের অন্যতম নেতা মোহাম্মদ ইব্রাহীম, করিম উল্লাহ বাদশা, মনোয়ারা মনি, সেলিম উল্লাহ, ওমচান গণি, নুরুল আজিম নিহাদ, কলাতলী উত্তর আদর্শগ্রাম সমাজ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, রিদুয়ানুর রশিদ আবিস্কার, জাহাঙ্গীর আলম, মিনহাজুল আবেদিন, হোসাইনুল ইসলাম, আব্দুল খালেক, সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন, মফিজুর রহমান, ভুট্টু, আব্দুল আজিজ, আবছার কামাল, আব্দুর রহমান, মো. আজাদ, মো. রানা, জসিম উদ্দিন ও তৌহিদুল ইসলামসহ অনেকেই।

কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়ন ও কক্সবাজার প্রেসক্লাবের বিবৃতি

কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়ন ও কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের, কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুল ইসলাম, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহেদ সরওয়ার সোহেল এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এক ট্রাফিক সার্জেন্ট প্রকাশ্যে মারধর ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত বেপরোয়া আচরণ। এটা কোনভাবেই মেনে নেয়ার বিষয় না। দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রাফিক সার্জেন্টের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়।

কক্সবাজার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত